বারিধারা

আজ সকাল থেকেই আকাশের মুখ গোমড়া। ঝড়, জল, বৃষ্টি, হয়েই চলেছে। ঘুম থেকে উঠেই সুমনের মাথাটা গরম হয়ে গেল। আজই হতে হল বৃষ্টি! আজ সেমিফাইনাল ম্যাচ – Shyamnagar Supers vs. Belgoria Tigers. Shyamnagar-এর opening batsman সুমন। 

১০ টার মধ্যে পৌঁছতে হবে। বৃষ্টির জন্য খেলা হয়ত পেছোবে। কিন্তু সাড়ে আটটা বেজে গেল। বৃষ্টি মাথায় নিয়েই বেরোতে হবে। বৃষ্টিতে ভিজতে তার কোনও অসুবিধে নেই, কিন্তু মুশকিল হল কিটটা নিয়ে। ওটা ভিজলে চলবে না। তার ওপর সাইকেল করে যেতে হবে ঘন্টা দুয়েক। ভেবেই মাথাটা গরম হয়ে গেল। কিচ্ছু খাবো না – এই বলে চেঁচিয়ে সাইকেলটা নিয়ে বেরিয়ে পড়ল সে। কিটটা যাতে না ভেজে ভালো করে pastic-এ জড়িয়ে নিতে হয়েছে। সে নিজে একটা raincoat চাপিয়েছে। রেগে মেগে সাইকেলটা নিয়ে বেরিয়ে পড়ল সুমন।

এই এক রোগ সুমনের। অল্পেতেই রেগে যায়। কার ওপর যে রাগে, কেনই বা এতো রেগে যায়, রেগে কার কী লাভ হয়, তা সে জানে না।  কিন্তু রাগ মারাত্মক হয় সুমনের।  যেমন মন্দিরে গিয়ে কেউ মা মা করে দশ টা টাকা দক্ষিণা দিল, কিন্তু পাশে বসা ভিখিরিটার দিকে ঘুরেও তাকালো না।  রাগ হয়ে গেল সুমনের। তারপর ধরো রাস্তায় পিচিক পিচিক করে গুঠখা ফেলা। মাথা আর ঠিক রাখতে পারে না সেটা দেখে। 

সেবার তো একটা দশাশই বিহারির সঙ্গে প্রায় হাতাহাতি হবার জোগাড়। গুঠখার পিক ফেলা নিয়েই বচসা। সেবারে তার বাবা কোনওরকমে সামাল দিয়েছিল পরিস্থিতিটা। 

-এত রাগিস না বাবা। রাগ চণ্ডাল।

তার বাবা সেবার তাকে বলেছিল। তা সে বছর দুয়েক আগের কথা।

আজ বৃষ্টির মধ্যে সাইকেল চালাতে প্রথম প্রথম রাগই হচ্ছিল। কিন্তু ঠাণ্ডা আবহাওয়ায় আস্তে আস্তে মাথাটা ঠাণ্ডা হয়ে গেল সুমনের। বৃষ্টিটাও একটু হলেও কমে এলো না? 

সকাল বেলা কিছু খাওয়া হয়নি। এবারে সত্যিকারের ক্ষিদে পেয়ে গেল সুমনের। একটা জায়গায় সাইকেলটা দাঁড় করিয়ে কিছু খেয়ে নেবে ভাবল। 

চা, টোষ্ট, ডিম, কলা। 

একটাই দোকান এখানে। ফাঁকা ফাঁকা জায়গাটা। আগেও গেছে এই রাস্তা দিয়ে, কিন্তু কখনো দাঁড়ানো হয়নি। দোকানের ভিতরে অর্ডারটা দিয়ে বাইরে এল সে হাতটা একটু পরিষ্কার করে নিতে। হাল্কা বৃষ্টি তখনো পড়ছে। 

ফাঁকা জায়গা। হাত টাত ধুয়ে খোলা হাওয়ায় শ্বাস নিতে নিতে দৃষ্টি সামনের দিকে মেলল। দূরে তাকাতেই ভ্রূটা কুঁচকে এল। একটা ছটফটানির মত কি জানি একটা হল না? 

মনে হল কিছু একটা struggle মত হচ্ছে। ঘটনাটা দূরে ঘটছে। ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। তার ওপর ঝিরঝিরে বৃষ্টিতে আবছা হয়ে আছে চতুর্দিক। 

ওই তো আবার!

এবারে মনে হল কয়েকটা ছেলে কার যেন একটা হাত ধরে টানাটানি করছে। ঝটাপটি হচ্ছে টের পেল সুমন। যা ভাবছে তাই নয়তো?

আর দেরী করল না সুমন। এক পা এক পা‌ করে এগোতে শুরু করল। 

প্রত্যেক পদক্ষেপে ঘটনাটা কাছে আসছে সুমনের। একটা নীল ফুল ফুল ফ্রক, চারটে ছেলে। রাগ আর সামলাতে পারল না সে। এবার দৌড় লাগাল।

ঝড়ের মত আছড়ে পড়ল সে। তার পাঁচ ফুট সাড়ে আট ইঞ্চির ছিপছিপে চেহারাটা যেন অত রাগ আর ধরে রাখতে পারছিল না। আজ চণ্ডাল জেগে উঠেছে। 

এক একটা ঘুঁষি যখন সে চালাচ্ছিল, তার সমস্ত রাগ, সমস্ত ঘৃণা ঢেলে দিচ্ছিল সে। সমস্ত শক্তি দিয়ে যেন সে জঞ্জাল পরিষ্কার করছে। আজ এখন কোনও কিছুকেই সে ভয় পায় না। 

মারপিটটা টিকল ঠিক দেড় থেকে দু মিনিট। তার মুখেও দু একটা পড়েছে। বাঁ নাকের পাশ দিয়ে রক্ত ঝরে পড়ছে। কিন্তু সুমন তখন তা বোঝার মত অবস্থায় নেই। 

ছেলেগুলো পালিয়েছে। অনতীদূরে পনেরো ষোলো বছরের মেয়েটি দাঁড়িয়ে। ঠকঠক করে কাঁপছে। বোঝা যাচ্ছে ভয় পেয়েছে। মেয়েটি তার দিকে তাকিয়ে আছে। হয়ত ভাবছে তার এই রক্ষাকর্তা, যে কোনওকিছুর তোয়াক্কা না করে তার জীবন বাঁচাল, তাকে সে কী বলবে। 

সুমনও মেয়েটির দিকে তাকিয়ে ছিল। কিন্তু কিছু ভাবছিল না। ভাবার মত অবস্থায় ছিল না। তার চোখদুটো রাগে জ্বলজ্বল করছে। হাত দুটো মুষ্টিবদ্ধ অবস্থায় শরীরের পাশে টানটান করে ধরে রাখা। এক রোখার মত দাঁড়িয়ে রয়েছে সে। যেন খুঁজছে আর কেউ বেঁচে আছে কি না।

প্রায় মিনিট খানেক এইভাবে দাঁড়িয়ে রইল সুমন। তারপর কিছুটা হলেও দেহটা শিথিল করল।  

মেয়েটার দিকে এক পা এগোল সে। মেয়েটা যেন ভয়ে পিছিয়ে গেল। আরও একবার চেষ্টা করল। আরও দুপা এগোল। নাহ! মেয়েটা সিঁটিয়ে যাচ্ছে।

তার ডান নাকের পাশ দিয়ে রক্ত গড়িয়ে পড়ছে। মাথাটা একটু হলেও টলমল করছে। সামনের পাথরটায় বসল সে। চোখ দুটো বুজে এল। কতক্ষণ যেন এভাবেই বসে ছিল। চোখ খুলল একটা মিষ্টি ডাকে।

  • দাদাবাবু!

চোখ খুলে তাকিয়ে দেখল মেয়েটি তার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। যা ভেবেছিল তার থেকেও কয়েক বছর কম বয়স। ডান হাতটায় নখের আঁচড়ের দাগ। 

সুমনের চোখদুটো একবার ধক করে জ্বলে উঠল। 

  • দাদাবাবু!

এবার তার স্বরে মিনতি।

কোনওরকমে রাগটা সামলাল সে। তাকে দেখে এই ক্ষুদ্র প্রাণটি ভয় পাচ্ছে। এটা সে মেনে নিতে পারল না। 

দেখল বাচ্ছাটা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। সুমনের মনে হল তার ক্রোধের গায়ে এই ক্ষুদ্র মানবীটির চোখের জল যেন স্নিগ্ধ বারিধারার মত ঝরে পড়ছে। তার অত্যুগ্র ক্রোধ নিমেশে শান্ত হল। 

আজ বড় ভালো লাগছে সুমনের। আজ তার মধ্যে চণ্ডাল জেগে উঠেছিল। তার অসুরকে সে আজ বশে আনতে পারেনি, চায়ওনি। যেটা চেয়েছিল, সে ঠিক সেটাই করেছে। 

খেলতে হয়ত তার যাওয়া হবে না। কিন্তু কোথায় যেন মনে হল Shyamnagar Supers-এর সেমিফাইনাল যেতার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ কাজ হয়ে গেছে। সে তার ক্রোধকে নিয়ন্ত্রণ করতে চায়নি, পারেওনি। কিন্তু হয়ত একটা দিশা দেখাতে পেরেছে। 

2 thoughts on “বারিধারা

Add yours

Leave a comment

Website Powered by WordPress.com.

Up ↑