গণনা

অমিয় কাজ টাজ খুব একটা কিছু করে না। তার মনে হয়, সকাল সকাল উঠে যারা কাজে যায়, তারা হয় পাগল, নয়ত জীবনে সুখের মর্ম বোঝে না। 

সুখ বলতে তারা বড় বড় জিনিস বোঝে, বড় গাড়ি, বেশি মাইনের চাকরি বা ব্যবসা, বড় বড় হোটেলে খাওয়া, এইসব। অথচ, অমিয়ের কাছে সুখ মানে সত্য সুখ। 

দুপুরে একমুঠো ভাত খেয়ে, তারিয়ে তারিয়ে গান শোনা, আর বিকেলে হাল্কা হাওয়ায় হাঁটতে বেরোনো। রাতে আবার খেয়ে, গল্পগুজব করে ঘুমিয়ে যাওয়া সেই দুপুর অব্ধি। অত কাজের কি কাজ বাপু!

এই করেই দিব্যি কাটছিল অমিয়ের। সকালে ঘুম থেকে ওঠার তাড়া নেই। ঘুম থেকে ওঠেই না সে সকালে। প্রাতরাশ খেয়ে তাড়াহুড়ো করে সময়ে কাজে বেরোনো সে সুখবিরোধি বলেই মনে করে। 

বেশ কাটছিল তার সুখের জীবন। একদিন পাড়ার টুবলুর সাথে বাজি ধরাটাই বোধহয় ভুল হয়ে গিয়েছিল। 

পাড়ার চায়ের দোকানে বসে চা খাচ্ছিল অমিয়। তার সাথে একটা পুরোনো গজল গুনগুন করছিল। 

টুবলু এসে বলল, অমিয়দা, তোমার কি মনে হয়, আজ মোহনবাগান জিতবে না হারবে? টুবলুর বয়স আট, চোখে মুখে সরলতার ছাপ। আর পাঁচটা ছেলে যেমন কম বয়সেই ডেঁপো হয়ে যায়, সেরকম নয়। 

অমিয় তখন খুব মন দিয়ে পিঁপড়ের সারি কিভাবে একটা চিনির দানা বয়ে নিয়ে যাচ্ছিল, সেটা লক্ষ্য করছিল। খুব একটা খেয়াল করেনি প্রথমে। 

টুবলু আবার প্রশ্ন করল – বল না অমিয়দা?

এবার হঠাৎ করে অমিয় বলে উঠল, আজ তো খেলা হবেই না। আশেপাশে চায়ের দোকানে তখন ম্যাচ নিয়ে তুমুল জল্পনা। চায়ের দোকানের খোকন তো মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গল বলতে পাগল। ভাগ্যিস কেউ শুনতে পায় নি। নয়ত নানা কথা শুনতে হত।  

অমিয় অবশ্য মজা করেই বলেছিল কথাটা, কিন্তু দেখা গেল কী একটা গোলযোগে খেলাটা সত্যিই হল না। 

সন্ধের সময় টুবলু হাঁ করে অমিয়র দিকে তাকিয়ে রয়েছে দেখল সে। 

  • তুমি না মহাপুরষ। 
  • ধুর, কী ভুলভাল বকছিস!
  • তবে আজ খেলাটা হল না জানলে কী করে?
  • ও তো এমনিই বললাম, লেগে গেল।
  • মহাপুরুষদের এমনি হয় গো। 
  • ভাগ!
  • আচ্ছা, বলো কাল বৃষ্টি হবে?
  • আমি কি করে জানব, তবে আবহাওয়ায় তো কিছু বলেনি। 
  • তুমি বল?
  • কি ভেবে অমিয় বলল, হবে। 
  • তবে দেখো হয় কি না!

পরের দিন আকাশ পরিষ্কারই ছিল যখিন অমিয় ঘুম থেকে উঠল, এবং সে এই ভেবে শান্তি পেল যে নাহ! অহেতুক মহাপুরুষ হয়ে ওঠেনি সে। কিন্তু বিকেল বেলা হঠাৎ অঝোরে বৃষ্টি নামল। 

অমিয় অবাক না হয়ে থাকতে পারল না। টুবলু দেখল দৌড়োতে দৌড়তে আসছে। 

  • দেখলে তো, বলেছিলাম কি না!

অমিয় যথেষ্ট অবাকই হয়েছিল। সমাপতন বলে উড়িয়ে দিত হয়ত। কিন্তু এর পর, পর পর তিন চার বার একই ঘটনা। 

একবার, গঙ্গার জল আজ পরিষ্কার থাকবে কিনা! একবার, এই গাছে ফুল ধরবে কিনা, এবং আরও দু একটা অদ্ভুত প্রশ্নের মুখোমুখি হয়ে নির্ভুল ভাবে সেই প্রশ্নের উত্তর দিতে পেরেছিল সে। 

আর যায় কোথা! লোকমুখে প্রচার হয়ে গেল, গুনেন্দ্রনাথ হালদারের ছেলে মস্ত বড় গুণিন হয়েছে। গণনা একেবারে নির্ভুল। 

পাড়ার বয়স্করা খুশিই হল। বলল, যাক বাবা, তোর বাবাটা ওপর থেকে দেখে খুশি হচ্ছে, ছেলে এতদিনে কিছু একটা করল। দেখিস তোর নাম চারিদিকে ছড়িয়ে পড়বে। 

তা পড়লও। দিন কে দিন অমিয়র পসার বেড়েই চলল। পাড়ার তো বটেই, পাশের পাড়া, এমন কি শহরের বাইরে থেকেও লোক আসা শুরু করল। 

অদ্ভুত ভাবে প্রায় সবকটা গণনাই মিলে যেতে থাকল। পুরোপুরি অবশ্য না। একবার একজন জিজ্ঞেস করেছিল, তার গোরুর মেয়ে বাচ্ছা হবে নাকি ছেলে বাচ্ছা। সে অবিলম্বে বলে দিয়েছিল ছেলে। কিন্তু গোরুটি বাচ্ছা বিয়োনোর আগেই মরে যায়। খুব একটা ভুল বলা যায় না, কিন্তু নির্ভুলও নয়। 

কিন্তু দু একটা ঘটনা বাদ দিলে, অমিয়র গননা নির্ভুল। এবং বহু মানুষের সমাগমে অমিয়র বাড়িও আজকাল লোকে পরিপূর্ণ। অনেক দূর দূর থেকে লোক আসে তার সাথে দেখা করতে। এখন তার জীবনযাত্রাও পালটে গেছে। 

এখন আর সেই আগের অমিয় নেই সে। ভোরবেলা উঠে গঙ্গাস্নানে যায়, ফিরে এসে গীতাপাঠ সেরে প্রাতরাশ করে, তারপরই লোকজন আসা শুরু হয়ে যায়। 

তার কাছে অবশ্য কেউ গোনাতে আসে না। সে শুধু কোনও ঘটনা হবে কি হবে না, বা কি হবে সেটা বলে দেয়। সমস্ত রকমের লোক, যেমন ঘোড়ার রেসের বাজিধর, জুয়োর বাজিধর, পরক্ষার্থি, মায় প্রেমিকদেরও আনাগোনা লেগেই থাকে। 

টুবলুরও দায়িত্ত্ব বেড়ে গেছে। অতিথিদের বসানো, আপ্যায়ন, এবং পরিশেষে তাদের কাছ থেকে প্রণামি বাবদ বড় কিছু আদায় করা এখন তারই দায়িত্ত্ব। 

এভাবেই গ্রীষ্ম পেরিয়ে বসন্ত এসে গেল। এই এক বছরে অনেক কিছুই পাল্টেছে। এখন নয় নয় করে হলেও প্রায় লাখ দুয়েক টাকা জমেছে তার ব্যাঙ্কে। 

মাঝে মাঝে শরীর খারাপ না হলে, রোজই তার আস্তানা খোলা, সকলের জন্য। ভাবছে গ্রীষ্মে AC টা লাগয়েই নেবে। 

একদিন সকাল সকাল সে তার ঘরে এসে বসেছে। কয়েকজন লোকও এসেছে, কিন্তু টুবলু হতচ্ছাড়াটা আসেনি এখনও। কে জানে, সচরাচর তো দেরি করে না। 

প্রথমজনকে ডেকে সবে ঘরে বসাবে, টুবলু দৌড়তে দৌড়তে ঘরে ঢুকল। 

  • অমিয়দা! সর্বনাশ হয়ে গেছে, মায়ের সকাল থেকেই শরীর খারাপ, মাথা ঘুরে পড়ে গেল একবার, তারপর আর জ্ঞান নেই। 
  • বলিস কী? আগে বলিসনি কেন?
  • কিছু করো না অমিয়দা।

কী করবে তৎক্ষণাৎ ভেবে নিল অমিয়। যারা এসেছিল তাদেরকে বিদায় দিয়ে, ঘরে তালা দিয়ে বেরিয়ে পড়ল কী হয়েছে দেখতে। 

টুবলুর বাড়ী গিয়ে যখন পৌঁছল তখন দেখল মাসিমা অচৈতন্য হয়ে পড়ে রয়েছেন। নাড়ীর গতি অতি ক্ষীণ, এখুনি হাসপাতালে ভর্তি করতে হবে। 

টুবলু দেখল পাশে দাঁড়িয়ে কাঁদছে। তার এই মা ছাড়া নিজের বলতে কেউ নেই। 

  • অমিয়দা কি হবে গো? বাঁচবে তো? বল না গো? 

টুবলুর চোখ তখন ভেসে যাচ্ছে। 

বহু দিনের অভিজ্ঞতা, এত দিনের প্র্যাকটিশ। সমস্তটা দিয়ে অমিয় বুঝল, নাহ! মাসিমা আর থাকবে না। 

  • বলো না গো, কিছু হবে না তো মায়ের?
  • ধুর পাগল, আমি আছি তো! চ।

ধরাধরি করে মাসিমাকে হাসপাতালে নিয়ে গেল অমিয়। হাসপাতাল বলল, ব্রেন স্ট্রোক। একটা সার্জারি করতে হবে। 

টুবলুকে বলা কথাগুলো তার নিজের কানেই ভাসছে তখন। আমি আছি তো!

সার্জারির প্রস্তুতি নিতে বলে সে চলে গেল ব্যাঙ্কে। জমানো যা কিছু ছিল, তুলে নিল। 

সার্জারি হল, জ্ঞানও ফিরল মাসিমার। টুবলুর তখন কী আনন্দ! মাকে চোখ মেলতে দেখে আনন্দে কাঁদছে সে তখন। 

অমিয়র মনে হল, এ যাত্রা নিজে ভুল হলে খুব ভালো হয়। কিন্তু ঈশ্বরের ইচ্ছে ভিন্ন। তিনদিন পর মাসিমা মারা গেলেন। হাসপাতালে যা চিকিৎসা করার দরকার ছিল, সবই করা হল। কিন্তু শেষ রক্ষা হল না। টুবলুর কোলে মাথা দিয়েই বুড়ি শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেছে। 

অমিয় সকালে হাসপাতালে এসে দেখল  টুবলু পাথর হয়ে বসে আছে। পাশে এসে দাঁড়াল অমিয়। অনেক্ষণ পরে টুবলু মুখ তুলে তাকাল। 

ক্ষীণ স্বরে বলল,

  • তুমি জানতে না? মা চলে যাবে?

অমিয়ও কেঁদে ফেলল। মিথ্যে কথা বলতে ইচ্ছে করল না অমিয়র। 

  • হ্যাঁ রে।

এবারে অমিয়র কোলে মাথা রেখে টুবলু হাউ হাউ করে কাঁদতে লাগল। খাণিক্ষণ পরে মুখ তুলে তাকাল। দুজনেরই চোখে জল। 

কী ভেবে অস্ফুট স্বরে টুবলু শুধু বলে উঠল, 

  • তুমি মহাপুরুষ।

2 thoughts on “গণনা

Add yours

Leave a comment

Website Powered by WordPress.com.

Up ↑